Flight MH370: আধুনিক সময়ের অমীমাংসিত অধ্যায়

মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের Flight MH370 বিমান আকাশে ওড়ার সময় news of bangla

২০১৪ সালের ৮ই মার্চ। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মাঝরাতে একটি যাত্রীবাহী বিমান উড়ে যায়—মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট এমএইচ৩৭০। গন্তব্য ছিল বেইজিং, চীন। বোর্ডে ছিলেন ২৩৯ জন যাত্রী ও ক্রু। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। যাত্রার ৪০ মিনিটের মাথায় হঠাৎ করে বিমানটি রাডার থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়। এরপর আর কখনো দেখা যায়নি এই বিমানটিকে। শুরু হয় এক বিশাল অনুসন্ধান অভিযান, এক আন্তর্জাতিক গোপন রহস্যের গল্প, যার উত্তর আজও পুরোপুরি জানা যায়নি।

বিমানটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ মডেলের। বহু ব্যবহৃত, আধুনিক প্রযুক্তিতে সজ্জিত। চালকের আসনে ছিলেন ক্যাপ্টেন জাহারি আহমেদ শাহ—অভিজ্ঞ পাইলট, ১৮ হাজার ঘণ্টার বেশি ফ্লাইট অভিজ্ঞতা। সহকারী ছিলেন ২৭ বছর বয়সী ফার্স্ট অফিসার ফারিক আব্দুল হামিদ। প্রথম ফ্লাইটে একা ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি।

ফ্লাইটটি কুয়ালালামপুর থেকে উড্ডয়ন করে মধ্যরাতে। সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। রাত ১টা ১৯ মিনিটে পাইলট সর্বশেষ কন্ট্রোল টাওয়ারে যোগাযোগ করেন: “Good night, Malaysian three-seven-zero”। এরপর রাডারে দেখা যায়, বিমানটি ভিয়েতনামের আকাশসীমায় প্রবেশের কথা। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই, বিমানটি রাডার থেকে একেবারে অদৃশ্য হয়ে যায়। কোনও বিপদ সংকেত, কোনও ইমার্জেন্সি কল, কিছুই আসেনি।

বিমানটি অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনাম উভয় দেশই বিমানটিকে খুঁজতে শুরু করে। প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল—বিমানটি সম্ভবত দক্ষিণ চীন সাগরে বিধ্বস্ত হয়েছে। সেখানে নৌবাহিনী, হেলিকপ্টার, সাবমেরিন, বিমান—সব কিছু দিয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়। কিন্তু কিছুই মেলে না। কোনও ধ্বংসাবশেষ, কোনও তেলের দাগ, কোনও লাইফ জ্যাকেট—কিছুই নেই।

এরপর মালয়েশিয়া সরকার স্বীকার করে, তারা বুঝতে পারছে না আসলে কী হয়েছে। তদন্ত চলতে থাকে। এক সপ্তাহ পর, বিশ্ব এক বিস্ময়কর তথ্য জানতে পারে—বিমানটি উড়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মালয়েশিয়ার সামরিক রাডারে ধরা পড়েছিল, যখন এটি অদ্ভুতভাবে পশ্চিম দিকে মোড় নিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। তার মানে, কেউ বিমানটির অটোমেটিক ট্রান্সপন্ডার বন্ধ করে দিয়েছিল—যা সাধারণত বিমানকে রাডারে দৃশ্যমান করে তোলে।

এই তথ্য প্রকাশের পর প্রশ্ন উঠে আসে—তাহলে কি এটা দুর্ঘটনা ছিল না? কেউ কি ইচ্ছা করেই বিমানটিকে হাইজ্যাক করেছে? পাইলটদের কেউ? যাত্রীদের কেউ? নাকি বাইরের কেউ?

অনেক তদন্তকারী এবং বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এটি ছিল একটি “ডেলিবারেট অ্যাকশন”—অর্থাৎ সচেতনভাবে কেউ এটি করেছে। ক্যাপ্টেন জাহারি তখন বিশেষভাবে সন্দেহভাজন হিসেবে পরিণত হন।

জাহারি একজন সম্মানিত, অভিজ্ঞ পাইলট ছিলেন। কিন্তু তদন্তে দেখা যায়, তার ব্যক্তিগত জীবনে কিছু অস্থিরতা ছিল। তিনি একা থাকতেন, পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল বিচ্ছিন্ন। তার বাড়িতে একটি অত্যাধুনিক ফ্লাইট সিমুলেটর ছিল, যেটিতে তিনি বিমানের রুট মডেল করে রেখেছিলেন—যেখানে দেখা যায়, সে বিমানটি ইন্ডিয়ান ওশানের দিকে নিয়ে গেছে, এক জায়গায় ফুয়েল শেষ হয়ে ঝরে পড়েছে।

তবে এই প্রমাণও যথেষ্ট নয়। কারণ এটি একটি থিওরি মাত্র। কেউ এখনো প্রমাণ করতে পারেনি, জাহারিই বিমানটির অন্তর্ধানের জন্য দায়ী।

বিমানটিতে ১৫টি দেশের যাত্রী ছিল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিলেন চীনের নাগরিক। এছাড়া মালয়েশিয়া, ইরান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইন্দোনেশিয়া, ফ্রান্স সহ আরও অনেক দেশের মানুষ ছিল। প্রত্যেক পরিবার ভেঙে পড়েছিল। একজন মা তার ছেলেকে ফোনে বলতে চেয়েছিল—“শিগগির ফিরে এসো”, কিন্তু সাড়া মেলেনি। একজন স্ত্রী তার স্বামীকে বলেছিল—“বাড়ি ফিরে এসো, তোমার জন্য অপেক্ষা করছি”—কিন্তু সেই অপেক্ষা শেষ হয়নি।

এই অনুসন্ধানে ২৬টি দেশ অংশ নেয়। স্যাটেলাইট, সাবমেরিন, ড্রোন, যুদ্ধজাহাজ, অ্যানালাইসিস—সব ব্যবহৃত হয়। অস্ট্রেলিয়ার নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান ওশানের দক্ষিণাংশে বিস্তৃত এক এলাকা চিহ্নিত করা হয়—যেখানে সম্ভাব্য বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে বলে মনে করা হয়।

২০১৫ সালে মোজাম্বিক ও রিইউনিয়ন দ্বীপের কাছে কিছু ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়—যা এমএইচ৩৭০-এর বলে চিহ্নিত করা হয়। এর মধ্যে ছিল বিমানের ফ্ল্যাপরন (পাখার একটি অংশ)। এতেই প্রমাণিত হয়—বিমানটি সত্যিই ইন্ডিয়ান ওশানে বিধ্বস্ত হয়েছিল।

কিন্তু এর পরেও, পুরো বিমান বা বাকিদের খোঁজ মেলেনি।

এই অন্তর্ধান নিয়ে প্রচুর ষড়যন্ত্র তত্ত্ব তৈরি হয়—কেউ বলেন, মার্কিন বাহিনী বিমানটি গুলি করেছে কারণ সেখানে কোনও গোপন কার্গো ছিল। কেউ বলেন, এটি ছিল সাইবার হ্যাক করে বিমান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেওয়ার ঘটনা। কেউ বলেন, রাশিয়া বা উত্তর কোরিয়া বিমানটিকে কিডন্যাপ করেছে।

এর সবই গুজব ও অনুমান, যেগুলোর কোনও দৃঢ় প্রমাণ নেই।

২০২৩ সালে নেটফ্লিক্সে মুক্তি পায় একটি ডকুমেন্টারি সিরিজ—“MH370: The Plane That Disappeared”। এতে উঠে আসে তিনটি প্রধান থিওরি:

1. **পাইলট থিওরি:** পাইলট ইচ্ছাকৃতভাবে বিমানটি ওড়ান ইন্ডিয়ান ওশানের দিকে এবং আত্মহত্যা করেন।

2. **হাইজ্যাক থিওরি:** কেউ বিমানটি হাইজ্যাক করে, সাইবার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়।

3. **মার্কিন বাহিনীর ষড়যন্ত্র থিওরি:** গোপন মালবাহী কিছু থামাতে মার্কিন বাহিনী বিমানটি গুলি করে।

এই তিন থিওরির কোনোটিকেই একেবারে নিশ্চিত বলা যায় না। প্রত্যেকটির পক্ষে কিছু যুক্তি আছে, আবার বিপক্ষে প্রশ্নও প্রচুর।

এখনো ১০ বছর কেটে গেছে। কিন্তু অনেক পরিবার এখনো অপেক্ষা করে, এখনো মনে করে—একদিন না একদিন সত্য সামনে আসবে। তারা প্রতিবছর ৮ মার্চ একত্রিত হয়, স্মরণ করে প্রিয়জনদের, দাবি তোলে—”আমরা শুধু জানতে চাই, কী হয়েছিল।”

ফ্লাইট এমএইচ৩৭০ একটি ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রহস্য হয়ে রয়ে গেছে। আধুনিক প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট, জিপিএস থাকা সত্ত্বেও এমন একটি বিমান কীভাবে হাওয়া হয়ে গেল—এ প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা।

এই ঘটনা শুধু একটি বিমান হারানোর গল্প নয়, এটি মানবজাতির সীমাবদ্ধতার, ভালোবাসার, অপেক্ষার, এবং এক অজানা শূন্যতার গল্প। আমরা এখনো আশাবাদী—একদিন সত্য সামনে আসবে, সেই ২৩৯ জনের কণ্ঠ, যাদের আর কখনো শোনা যায়নি, তারা একদিন আমাদের বলবে—”আমরা কোথায় ছিলাম।”